বাংলাদেশে ধর্ম এবং অধিকারঃ একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখা

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলামের সমালোচক বিভিন্ন ব্লগারদের বীভৎস হত্যাকাণ্ড আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে অধিকার ও উন্নয়ন কর্মীরা এই দেশে একটি ক্রমশ বর্ধমান অসহিষ্ণু ও বিপদজনক প্রেক্ষাপটে কাজ করার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য কি ধরনের বিপদের মুখোমুখি হয়।

মাত্র এক মাসে দুইজন ব্লগারকে প্রকাশ্যে খুন করার ঘটনা ২০১৩ সালকে মনে করিয়ে দেয় যেসময়ও একজন ব্লগার নিহত হয়েছিলেন। এক দশক আগে, একজন বিখ্যাত লেখক ইসলাম সম্পর্কে তার সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ঠিক একই ধরনের হামলার শিকার হয়েছিলেন। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ ছোট-বড় বিভিন্ন সশস্ত্র  ইসলামী সংগঠনের উথ্যান দেখেছে যারা আদালত কিংবা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিস্ফোরকসহ হামলা চালিয়েছে।

এবং এই কালো অধ্যায়ে প্রবেশের আগে, বাংলাদেশ নিজেদেরকে বিশ্বের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে তুলনামূলক সহিষ্ণু ও ধর্মীয় সহাবস্থানের ক্ষেত্রে একটি আদর্শ হিসেবে তুলে ধরতে পারত। গত ২৪ বছরের মধ্যে ২২ বছরই দেশটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নারী নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসন প্রত্যক্ষ করেছে। এটি নোবেল পুরষ্কার জয়ী গ্রামীণ ব্যাংক এর জন্মস্থান যারা বাংলাদেশের প্রায় সত্তর লাখ প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্রঋণ এর আওতায় নিয়ে এসেছে, যার ৯৭% ই নারী। একইসাথে এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ যেই শিল্পের প্রায় ৮০% শ্রমিকই নারী।


Demotix/Mamunur Rashid (All rights reserved)

Bangladeshis hold a torch-light vigil for slain blogger Ananta Bijoy Das.


দেশটিতে এনজিও ব্যুরো নিবন্ধিত ২৩০০ এর বেশি বেসরকারি সংস্থা এবং প্রায় ১০০,০০০ প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা মানবাধিকার, নারী অধিকার,পরিবার পরিকল্পনা এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করে। এদের মধ্যে ব্র্যাক অন্যতম যেটি বিশ্বের বৃহত্তম এনজিও।

এতো কিছুর পরও পরিবর্তনটা আসলে কোথায় হল? এই প্রশ্নে মানবাধিকার ও উন্নয়ন কর্মীদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে। বছরের পর বছর বিভিন্ন ধর্মীয় পক্ষ এবং মানবাধিকার ও উন্নয়ন কর্মীরা একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছেঃ কখনও সহযোগিতা,কখনও একে অপরের মুখোমুখি,কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই একে অন্যের পথ এড়িয়ে চলেছে।

অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সক্রিয় ভূমিকার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট এর সম্মানিত পরিচালক সারা হোসেন লক্ষ্য করেন যে আলেম সমাজ (যারা কখনও কখনও সমাজের নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন) সফলতার সাথে বিভিন্ন প্রকল্প,বিশেষ করে উন্নয়ন প্রকল্প,এর প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে থাকেন।

এরকমই একটি প্রকল্প ছিল,১৪৭৫৭০ কিঃমিঃ আয়তনের একটি দেশে ১৬ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশের সরকার পরিচালিত পরিবার পরিকল্পনা প্রকল্প যা ১৯৭০ থেকে শুরু হয়। সরকারগুলো এই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সফলতা দেখিয়েছে যার ফলে দেশটির জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৯৭১ সালের ৬.৯৪ থেকে  ২০১১ সালে ২.৩ এ নেমে আসে।

ধর্ম মন্ত্রণালয় এর সহযোগী হিসেবে স্থানীয় ইমাম ও মুয়াজ্জিনরাও এই প্রকল্প বাস্তবায়নে জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সবদিক থেকেই এটি ছিল একটি বিশাল সাফল্য। ক্যাথোলিক ধর্মের বিপরীতে ইসলাম ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সাধারণত জন্ম নিয়ন্ত্রণকে নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইসলাম ধর্মের বিপরীত অবস্থান থাকা সত্ত্বেও এরকম একটি স্পর্শকাতর ইস্যুতে সরকার ও উন্নয়ন কর্মীদের কাজ করার সুযোগ করে দেওয়াকে সফলতাই বলতে হবে।

বিপরীত ঘটনাগুলো ঘটে যখন মানবাধিকার আন্দোলন সরাসরি ধর্মীয় ব্যাপারের সাথে সাংঘার্ষিক হয় এবং এক্ষেত্রে অসহযোগিতার দৃষ্টান্ত লক্ষণীয়।

 বিপরীত ঘটনাগুলো ঘটে যখন মানবাধিকার আন্দোলন সরাসরি ধর্মীয় ব্যাপারের সাথে সাংঘার্ষিক হয় এবং এক্ষেত্রে অসহযোগিতার দৃষ্টান্ত লক্ষণীয়। ২০১১ সালের বহুল প্রতীক্ষিত নারী উন্নয়ন নীতি রাজনীতি, শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নারী উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা বললেও সম্পত্তি উত্তরাধিকারে নারীর সমঅধিকারের ব্যাপারটি উপেক্ষা করে যায় যা নারী অধিকার কর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

যখন অধিকারকর্মীরা এই বিষয়ে কথা বলে তখন সরকারের একজন মন্ত্রী বলেন ‘যখন আপনারা রাজপথে ধর্মীয় নেতাদের মত জনসমাগম করতে পারবেন, তখনই কেবল আপনাদের দাবী মেনে নেওয়া হবে।’ অন্যদিকে সরকারের কানে অসন্তোষের কম্পন পৌঁছানোর পরপরই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি বিশেষ বৈঠক ডেকে ধর্মীয় নেতাদের আশ্বস্ত করেন যে এই পলিসি তে ইসলাম বিরোধী কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই।

যখন অধিকার কর্মী ও ধর্মীয় গ্রুপের মাঝে একটি সহযোগিতা ও সাহায্যের সফল উদাহরণ খুঁজে পাওয়া সম্ভব, তখনই সাম্প্রতিক সময়ে তাদের মাঝে একটি সাংঘার্ষিক রূপ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সারা হোসেনের মতে, ধর্ম এখন কেবলমাত্র একটি বিশ্বাস ব্যবস্থা নয়, বরং এটি একটি সংগঠিত রাজনীতিতে রূপ নিয়েছে। গত প্রায় দেড় দশকে, অধিকার কর্মীদের পদ্ধতি অনুসরণ করে, বহু ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ তাদের অনুসারীদের নিয়ে সংগঠিত হয়েছে এবং সশস্ত্র বাহিনী গঠন করেছে। এবং তাদের লক্ষ্য হল বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন, গণমাধ্যম এবং নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ; যার ফলে অধিকার কর্মীরা তাদের পথ নিয়ে ভীত হয়ে পড়ছে।

যেই দেশটি তার জন্মের পর মাত্র চার দশকেই স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নারী কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক অগ্রগতি সাধন করেছে, ধর্মীয় উগ্রপন্থার জন্য সেই দেশেই অধিকার ও উন্নয়নে বাধা নিতান্তই দুঃখজনক। সর্বোপরি, সেই মুষ্টিমেয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম যার সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার উল্লেখ আছে।

এমন পরিস্থিতি মোকাবেলার একটি উপায় হল ধর্মীয় অনুভূতিতে সরাসরি আঘাত আনতে পারে এমন ভাষা বা ক্রিয়া থেকে বিরত থাকা। বস্তুত বিশ্বের মানবাধিকারের মূল্যবোধের বিপরীত হলেও বাস্তবতা হল এই অনুভূতি এখনো বাংলাদেশের মানুষের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমে গর্ভপাত স্বাভাবিকভাবে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করা গেলেও এটাকে বিরাটভাবে প্রচার প্রচারণা করতে গেলে মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরাই সর্বপ্রথম এটার বিরোধিতা করে। কারণ সেটা করতে গেলে তাদের সমস্ত সফলতা ভেস্তে যেত এবং এমনকি তারা ধর্মীয় বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হত।

এমতাবস্থায় প্রধান ঝুঁকিটা হল, অধিকার কর্মিরা মাত্রাতিরিক্ত সতর্কতার ফলে এই ইস্যুতে একটি শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে ব্যর্থ হতে পারেন। শেষমেষ, অধিকার কর্মীরা এখন যেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি সেটি হল ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখা, অথবা অন্তত ধর্মীয় গ্রুপগুলোর সাথে বিবাদে না জড়িয়ে নিরাপদ থাকা এবং মানবাধিকার এর পক্ষে অবস্থান নেওয়া।