গণহত্যা এক ধরণের রাষ্ট্রীয় দুষ্কর্ম,তাই পরাষ্ট্রপুঞ্জেকেই গণহত্যার বিরূদ্ধে সরব হতে হবে

Photo: Tansim News Agency/Seyyed Mahmoud Hosseini


মিয়ানমারের রোহিংগারা অবশ্যই দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা গণহত্যার শিকার, এবং তাদের সীমাহীন দুর্দশা্র সঙ্গে অস্তিত্বের প্রশ্নটি জড়িত। দশকের পর দশক জুড়ে রোহিংগাদের নিশ্চিহ্ন করা, এবং হত্যা, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসসহ আতংক উস্কে দেওয়ার কারণে রাখাইনে বর্তমানে বড়জোর ১৫% রোহিংগা বাস করছে। ২০১৭ সাল হতে ৭,৫০,০০০ রোহিংগা সীমাহীন দারিদ্রপীড়িত অবস্থায় বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের তিন ভাগের একভাগ (সংখ্যায় ১৪০০০০ এর মত) মিয়ানমারের কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে আটকা। অন্যরাও বড়জোর বাঁচার জন্যই দূর্ভোগের ভিতর বেঁচে আছে। অজস্র নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্রই দেখাচ্ছে যে মিয়ানমারের হত্যাযজ্ঞ নিঃসন্দেহে প্রমানিত একটি গণহত্যা। তথ্যসূত্রগুলোর  মধ্যে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান কমিশন, তদন্তকারী দলসহ অনেকগুলো এনজিও রয়েছে।     

এই অভিযোগগুলোতে স্পষ্টভাবেই দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা আছে যার মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদেরকে সহজেই বিচারের আওতায় আনা সম্ভব। অনেকগুলো প্রতিবেদনেই দায়ী মিলিটারি কমান্ডারদেরসহ সহযোগী বেসামরিক ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা আছে। অ্যাতোসব সন্দেহাতীত অভিযোগ থাকার পরও দায়ী ব্যক্তিদের অপরাধের শাস্তি বিধানের জন্য জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হেলাফেলা ও প্রচ্ছন্ন ভূমিকা নেওয়ার কারণে সমস্যাটি হতে সকলের দৃষ্টি সরে পড়ছে। উল্লেখ্য, শুধু ব্যক্তি অপরাধীদের জন্য সীমিত রাখাই নয়, রাষ্ট্রকেও অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

শুধুমাত্র ব্যক্তি অপরাধীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা গণহত্যার মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে ভুল বুঝার নামান্তর।  গণহত্যা কনভেনশনটির মোদ্দা কথা হচ্ছে গণহত্যার বিচার রাষ্ট্রগুলোর একটি অত্যাবশ্যক রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। এই দায়িত্ব ব্যক্তিক দায়িত্ব [ঘৃণ্য অপরাধের জন্য ব্যক্তির শাস্তি] হতে সম্পূর্ণ পৃথক। রাষট্র যে বিশেষ ক্ষমতাধর ক্রীড়নক এই সত্যটি গভীরভাবে বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।  আন্তর্জাতিক আইনেই রাষ্ট্রকে নীতি-নির্ধারণের ও আইন প্রণয়নের সার্বভৌম ক্ষমতা দেওয়া আছে। বৈশিষ্ট্যের দিক হতে গণহত্যা শুধুই কিছু ব্যক্তির বিচ্ছিন্ন কিছু অপরাধের সমষ্টি নয়—যদিও ব্যক্তিবর্গ কিছু কিছু গণহত্যামূখী অপরাধ করতে সক্ষম। মুলকথা, কিছু অপরাধ শুধুই ব্যক্তির দ্বারা সংঘটিত হওয়া সম্ভব নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ব্যক্তির পক্ষে তো কারো নাগরিকত্ব হরণ সম্ভব নয়। এটি একান্তই রাষট্রের এখতিয়ারভূক্ত। রোহিংগাদের প্রতি তীব্রতম বৈষম্য এবং   নৃশংস আচরণের পাশাপাশি তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকারেই রাষ্ট্রের বিদ্বেষী মনোভাব সুস্পষ্ট, এবং নির্বিচার নিধনযজ্ঞই প্রমান করার জন্য যথেষ্ঠ যে গণহত্যাটি রাষ্ট্রীয় মদদেই সম্পন্ন হয়েছে।

পুনশ্চঃ, তাতমাদও মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী যা রাষ্ট্রীয়ভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা দ্বারা ব্যপক ক্ষমতাশালী করে গড়ে তোলা হয়েছে। তাতমাদও গ্যাং নয়, মিলিশিয়ার দল। তারা রাষ্ট্র হতে বিযুক্ত নয়, কিন্তু রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আইনসঙ্গত উপায়েই সশস্ত্র বাহিনীকে শক্তি প্রদর্শনের একক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে দিতে মূল ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করে। এর অর্থ এই যে বিভিন্ন তদন্ত ও অনুসন্ধানে  উল্লেখ হওয়া ব্যক্তি অপরাধকে বড় করে দেখানোর চাইতে রাষ্ট্র  মূল অপরাধের জন্য দায়ী করা প্রয়োজন। আরো স্পষ্টভাবে বলা যায় যে ২০১৭ সালের আগস্টের নির্বিচার ধর্ষণযজ্ঞ আকস্মিক বা বিচ্ছিন্নভাবে ব্যক্তিদের দ্বারা সংগঠিত বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না।  সেগুলো ছিল পরিকল্পিত ও সমন্বিত যৌন আগ্রাসন। মায়ানমার রাষ্ট্র রোহিঙ্গা নারীদের পরিকল্পিতভাবে গর্ভবতি করার সুযোগ উস্কে দেয়া ছাড়াও ধর্ষকদের দায়মুক্তির ব্যবস্থা করে করেছে।  রোহিংগাদের গোষ্ঠীগতভাবে বা গোষ্ঠীর অংশবিশেষকে ধ্বংস করাই ছিল উদ্দেশ্য। গণহত্যার সংজ্ঞা অনুযায়ি এই অপরাধ স্পষ্টই গণহত্যার অংশবিশেষ।

মিয়ানমার রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদ ব্যতীত এই রকম ব্যপকতম অপরাধ সংঘটিত হতে পারত না, কিংবা এখনো চলতে পারত্ না।  অনেকগুলো রাষ্ট্রই অপরাধটি গণহত্যা স্বীকৃতি দিয়েছে। বর্তমানে জাতিসঙ্ঘের জেনোসাইড কনভেনশন-এ অন্তর্ভূক্ত দেশের সংখ্যা ১৫০টি, যা সদস্য রাষ্ট্রসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ। কনভেনশনটির ৯ নম্বর ধারার ভাষ্যমতে গণহত্যার শাস্তিব্যবস্থা বাধ্যতামূলক।  বিতর্কিত বিষয় “আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) উত্থাপন করতে হবে”। যুক্তিসংগত কারণেই প্রত্যাশা করা যায় যে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বেশিরভাগের সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধিত্বশীল দল জেনোসাইড কনভেনশনের অধীনে মিয়ানমারের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা উত্থাপিত হবে। কারণ, জেনোসাইড কনভেনশন দ্বারাই গণহত্যার বিচারকে আইনানুগ করা হয়েছে। আইসিজে-তে এই রকম একটি কর্মসূচী রাজনৈতিকভাবে ও আইনগতভাবে গণহত্যা প্রতিরোধে ব্যপক ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।         

রাজনৈতিকভাবে এই কর্মসূচী চলমান গণহত্যা প্রতিরোধের জন্য একটি তাৎক্ষণিক উন্মুক্ত আলোচনামঞ্চেরও  জন্ম দিবে। অপরাধ সংগঠনকারী রাষ্ট্রের প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শন রাষ্ট্রপুঞ্জের জন্য এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সুনামহানিকর এবং স্বাভাবিক ব্যবসার জন্য বাধা হয়ে উঠতে পারে। বড় অংকের বাধ্যগত ক্ষতিপূরণ গোনার সম্ভাব্য কারণও হয়ে উঠতে পারে। গুটিকয়েক অপরাধীর বিচার হলে লগ্নিকারীরা এইসব ভয়কে ধর্তব্যের মধ্যেও নিবে না। রাষ্ট্রের আইন ও আইনের চর্চ্চাকে আইনানুগ নয় ঘোষণা দেবারও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব আছে, এবং অবাক হবার কিছু নেই যে আইসিজের সিদ্ধান্ত সাধারণ্যে সাদরে গৃহিত হবে।

এইরকম কর্মসূচির সুবিধাগুলো তাৎক্ষণিকাবেই মিলবে। সম্ভাবা আছে যে আদালত কিছু অন্তর্বর্তিকালীন ব্যবস্থা নিবে। মিয়ানমারও সেগুলো মানতে বাধ্য থাকবে, নয়তো মানতে ব্যর্থ হলে রায়ে অবমাননার দায়ে আরো বেশি শাস্তির আওতায় আসতে হতে পারে।  মামলাটি বিশ্বের চোখে মিয়ানমারের আনুষ্ঠানিক অবস্থানকেও স্পষ্ট করে তুলবে, এবং আরো গভীরতর নিরীক্ষার সু্যোগ তৈরি করবে। ক্ষতিপুরণের ক্ষেত্রে রোহিংগাদের নিজ নিজ আবাসে ফেরার, এবং সম্পদ ও সম্পত্তি ফিরে পাওয়াসহ  ন্যয্য ক্ষতিপুরণ পাওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। এর সব কিছুই আইসিজের কর্মসূচীর অধীনে হতে পারে। আইসিজের অধীনে ব্যক্তির বিচার খুবই দীর্ঘসূত্রী হয়,এবং প্রায়শই তা ব্যক্তির ক্ষমতা ছাড়ার অনেক পরে সম্পন্ন হয়। আইসিজের সাম্প্রতিক বিচারগুলোর হতাশাকর অভিজ্ঞতা হতে এইরকম ধারণাও করা সম্ভব যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিচার ব্যর্থ হবার সম্ভাবনাও একেবারে কম নয়।    

আলোচনাটির সারমর্ম এই যে আইসিজে তাৎক্ষণিক এবং সহজ নাগালের মধ্যে খুবই যথার্থ এবং কার্যকর একটি আশ্রয়স্থল। কোনোরকম ছলাকলা-কৌশল, সত্যের অপলাপ, সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া বা প্রচলিত আইনেই বিচারের চেষ্টা প্রতিহত করা প্রয়োজন। এটি শুধুমাত্র রোহিংগাদের অস্তিত্বের বিষয়ই নয়, বরং এক্ষুণি মামলার উদ্যোগ নেবার যৌক্তিক কারণ হিসেবে এককভাবেই যথেষ্ঠ শক্তিশালী কারণ বলা চলে। আন্তর্জাতিকভাবে আইনের শাসন ও মানবাধিকার সুরক্ষার গুঢ়তম মুল্যবোধের অস্তিত্বের প্রশ্নেও মামলাটি হওয়া প্রয়োজন। গণহত্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের দ্বিধাগ্রস্থ বা ইতস্তত করার কোনো সুযোগ নেই।